শ্রমের মর্যাদা রচনা ২০, ২৫ পয়েন্ট | শ্রমের মর্যাদা অনুচ্ছেদ
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, আশা করি সবাই ভালো আছো! আজকের এই পোস্টে তোমাদের জন্য শ্রমের মর্যাদাটি শেয়ার করতে চলেছি। শ্রমের মর্যাদা রচনাটি সহজ ও সাবলীল ভাষায় লেখা হয়েছে, যেন একবার পড়লেই মুখস্থ হয়ে যায়।
এই রচনাটিতে ২৫টি পয়েন্ট ব্যবহার করা হয়েছে এবং কোনো অপ্রয়োজনীয় লাইন বা তথ্য যোগ করা হয়নি, যা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে সাহায্য করবে।
শ্রমের মর্যাদা রচনা
নিচে শ্রমের মর্যাদা রচনাটি সহজ ও সাবলীল ভাষায় লেখা হলঃ
ভূমিকা
এই সুবিশাল পৃথিবী হলো বিশ্ববিধাতার এক বিশাল কর্মশালা। এখানে প্রত্যেক মানুষকে তার সাধ্যমতো পরিশ্রম করতে হয় এবং শ্রম দিতে হয়। সবাই যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী পরিশ্রমের অপরিহার্য উপাদান দিয়ে এই জগতকে সজ্জিত করে। আর এভাবেই সভ্যতার সৌধটি হয়ে ওঠে মন মুগ্ধকর।
সভ্যতার এই চরম উন্নতির মূলে রয়েছে যুগ যুগ ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষের অফুরন্ত শ্রম। বহু মানুষ তাদের দীর্ঘদিনের শ্রম দান করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে সভ্যতার এই অসাধারণ রূপ। তারা কঠোর পরিশ্রমে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করেছে, সেতু নির্মাণ করে নদীর দুই পাড়কে যুক্ত করেছে, এবং নির্মাণ করেছে বড় বড় প্রাসাদ ও অট্টালিকা।
শ্রম কী
শ্রমের আভিধানিক অর্থ হলো মেহনত বা শারীরিক ও মানসিক খাটুনি। যেকোনো কাজই শ্রমের অন্তর্ভুক্ত। তবে, পরিশ্রম বলতে আমরা সাধারণত আন্তরিক প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়কে বুঝি। এই পরিশ্রমের মাধ্যমেই মানুষ নিজের ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে পারে এবং সমাজ ও সভ্যতাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
পরিশ্রমভিত্তিক শ্রমের শ্রেণিবিভাগ
মানুষ এই পৃথিবীতে সমাজ গঠন করেছে। সমাজের উন্নতির জন্য প্রত্যেকেরই পরিশ্রম করা প্রয়োজন। কিন্তু সবার পক্ষে সমাজের সব কাজ একা করা সম্ভব নয়, কারণ তাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এই সামাজিক বিশৃঙ্খলা এড়াতে মানুষ সমাজের কাজগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করেছে। শ্রম সাধারণত দু’প্রকার। যথা- ক. মানসিক শ্রম। খ. শারীরিক বা কায়িক শ্রম।
শ্রমের মহিমা
মানুষ জন্মগতভাবেই কিছু না কিছু সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী। আর এই সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ একমাত্র শ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব। মানুষ নিজেই তার ভাগ্যনির্মাতা। পরিশ্রমের মাধ্যমেই মানুষ নিজের ভাগ্য গড়ে তোলে।
ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, পৃথিবীতে যেসব মানুষ স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের সফলতার মূল চাবিকাঠি ছিল কঠোর সাধনা ও পরিশ্রম। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই মানবসভ্যতা ক্রমাগত সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে।
উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের আজকের উন্নতি সম্পূর্ণরূপে পরিশ্রমেরই অবদান। যে জাতি শ্রমকে সঠিক মূল্য দিতে পেরেছে, সেই জাতিই জগতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। কঠোর পরিশ্রমই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মহিমা এনে দিয়েছে।
শ্রমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
মানবজীবনে শ্রমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কাজ ছোট হোক বা বড় হোক, সকলেরই কাজের প্রয়োজন আছে। যার যার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মধ্যেই জীবনের সুখকর অস্তিত্ব নির্ভরশীল। কারণ, জীবনের উন্নতির চাবিকাঠি পরিশ্রমের মধ্যেই বিদ্যমান। শ্রমের এই অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনা করেই আমাদের এর মর্যাদা দিতে হবে।
আজকের বিশ্বের বিপুল অগ্রগতির পেছনে যেমন শ্রমজীবী মানুষের অবদান রয়েছে, তেমনি শ্রমজীবী সমাজের অসহযোগিতা জীবনকে বিষময় করে তুলবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তারা শ্রমের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ বলে তাদের উন্নতি এত ব্যাপক হয়েছে।
সেসব দেশে ছোট-বড় বলে কোনো পার্থক্য নেই। কাজ যাই হোক না কেন, তাতে কোনো অমর্যাদা লুকিয়ে থাকে না। কায়িক বা দৈহিক পরিশ্রম সেসব দেশে কখনোই কোনো অগৌরব নিয়ে আসে না। তাই সকলেই সবরকম কাজের প্রতি সমান আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। জীবনের সঙ্গে শ্রমের একটি নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান।
পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি
পরিশ্রম ছাড়া সৌভাগ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। সাফল্যের জন্য ধৈর্য এবং কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সুপ্ত প্রতিভা থাকে, যা শুধুমাত্র পরিশ্রমের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।
অলস মানুষ সমাজের জন্য একটি বোঝাস্বরূপ। অন্যদিকে, পরিশ্রমী মানুষ শুধু তার নিজ জীবনকেই নয়, বরং সমাজ ও জাতিকেও সমৃদ্ধ করে তোলে।
মহামানবদের কাছে শ্রমের মর্যাদা
প্রত্যেক মহামানবই শ্রমের মর্যাদা দিয়েছেন এবং পরিশ্রমের মাধ্যমেই সমাজের উন্নতি সাধন করেছেন। আদি মানব আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) নিজ হাতে কাজ করেছেন। ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রাঃ) নিজেও কঠোর পরিশ্রম করতেন।
আরও উদাহরণ হিসেবে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, “A hard working street cleaner is better than a lazy scholar.” (অর্থাৎ: একজন কঠোর পরিশ্রমী ঝাড়ুদারও একজন অলস জ্ঞানীর চেয়ে ভালো।)
জাতীয় জীবনে শ্রমের মর্যাদা
আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশ নানা সমস্যায় জর্জরিত। জাতির এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ব্রিটেন, রাশিয়া, আমেরিকা, জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোর আজকের উন্নতির মূলে আছে কঠোর পরিশ্রম। তাই আমাদের জাতীয় জীবনেও শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা অত্যন্ত জরুরি।
উন্নত বিশ্বে শ্রমের মর্যাদা
বিশ্বের যে সকল দেশ আজ গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে উন্নতির আসনে বসে আছে, তাদের অগ্রগতির মূলে রয়েছে শ্রমের মর্যাদা। সেসব দেশের মানুষ শ্রমকে যথাযথ সম্মান দিতে জানে এবং কোনো কাজকেই তারা ছোট করে দেখে না।
দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশের শ্রমিকের যথাযথ মর্যাদা নেই বলেই তারা কাজের প্রতি উদাসীন হয়ে বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হয়। চীন, জাপান, ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি উন্নত দেশে শ্রমকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়।
এসব দেশের উন্নয়নের পিছনে রয়েছে ব্যাপক শ্রম তৎপরতা এবং শ্রমের প্রতি অসামান্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন। আমাদের দেশেও যদি এই রূপ শ্রমের মর্যাদা দেওয়া হয়, তবে দেশ দ্রুত উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছাতে পারবে।
ছাত্রজীবনে শ্রমের গুরুত্ব
ছাত্রজীবনকে বলা হয় মানবজীবনের বীজ বপণের সময়। এই সময়ে মানুষ তার নিজের জীবনকে নিজের মতো করে গড়তে শেখে। তাই ছাত্রজীবনে শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। যেসব ছাত্রছাত্রী কঠোর পরিশ্রম করে লেখাপড়া করে, তারাই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে সক্ষম হয় এবং পরবর্তী জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তারা সফলতা পায়।
অন্যদিকে, অলস ও কর্মবিমুখ শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা না করে অন্যান্য খারাপ কাজে লিপ্ত থাকে। ফলে তারা পরীক্ষায় তো খারাপ ফলাফল করেই, জীবনের পরবর্তী সময়েও তারা কোনো উন্নতি করতে পারে না। এর ফলে পরবর্তীতে তাদের হতাশার জীবন কাটাতে হয়। তাই ছাত্রজীবনে পরিশ্রমের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
আমাদের দেশে শ্রমের মর্যাদা
ব্যাপারটা দুঃখজনক হলেও বলতেই হয় যে, এদেশে কায়িক বা শারীরিক শ্রম এখনও পূর্ণ মর্যাদা পায়নি। শ্রমবিমুখতা প্রায় আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখাপড়া শিখে কলম পিষে কে কত বড়লোক হবে, এটাই এখন সকলের স্বপ্ন।
এরা সকল কায়িক শ্রম ও শ্রমিকের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে এবং ন্যায্য মজুরি থেকে তাদের বঞ্চিত করে। তাই আমাদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই প্রাচীন ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তবেই দেশের শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য মর্যাদা ফিরে পাবে।
শ্রম ও সভ্যতা
প্রাচীন সভ্যতার শুরুতে মানুষ কায়িক ও মানসিক শ্রমের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করে এবং পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলেছিল। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে মানুষের পরিশ্রমের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
নারী ও শ্রম
শ্রম বাজারে নারীদের অবদান অপরিহার্য। যদিও তারা বহু চ্যালেঞ্জ এবং বৈষম্যের মুখোমুখি হয়, তবুও নারীরা অর্থনীতির প্রতিটি খাতে অবদান রেখে চলেছে। উৎপাদন খাত থেকে শুরু করে সেবা খাত পর্যন্ত তাদের দক্ষতা ও নেতৃত্বের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
তবে, নারীরা প্রায়ই কম মজুরি, পেশাগত উন্নতির সীমিত সুযোগ, এবং কর্মস্থলে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও হয়রানির সম্মুখীন হন। সমান কাজের জন্য সমান মজুরির অভাব এবং কাজ ও পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রাখার চ্যালেঞ্জ তাদের পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
দক্ষতা ও শ্রম
দক্ষতা বৃদ্ধি হলো শ্রমের মানোন্নয়নের একটি প্রধান কৌশল, যা ব্যক্তি, সংস্থা এবং রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। দক্ষতা বৃদ্ধি শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা এবং সৃজনশীলতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে পণ্য ও সেবার মান উন্নত হয় এবং বাজারে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার সৃষ্টি হয়।
প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতার উন্নয়ন করা শ্রমিকরা নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি সহজে আয়ত্ত করতে পারে। এর ফলে উৎপাদনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি অপচয় হ্রাস করা যায়। শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিকে আরও টেকসই করে তোলা যায় এবং বিশ্ববাজারে রাষ্ট্রের অবস্থানকে সুদৃঢ় করা যায়।
শ্রম ও শিশু শ্রম
শিশু শ্রমের সমস্যা বৈশ্বিক পরিসরে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এটি শ্রমের মর্যাদা ও সামাজিক উন্নয়নে গভীর প্রভাব ফেলে। শিশু শ্রম শিশুদের শিক্ষার অধিকার নষ্ট করে, তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে এবং শিশুদের দুর্বলতা ও শোষণের ঝুঁকিতে ফেলে।
এটি শ্রম বাজারে দারিদ্র্য ও অসাম্যের চক্র অব্যাহত রাখে, কারণ শিশু শ্রমিকরা দক্ষতা ও শিক্ষা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। শ্রমের মর্যাদার উপর এর প্রভাব হলো, সমাজে দীর্ঘমেয়াদি অসাম্য এবং অর্থনৈতিক অক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া।
শ্রম ও পরিবেশ
শ্রম ও পরিবেশের সম্পর্ক টেকসই উন্নয়নে মৌলিক ভূমিকা পালন করে। এই সম্পর্কটি বুঝতে হলে কর্মস্থলের প্রভাব ও পরিবেশগত দায়বদ্ধতাকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। স্থায়ী শ্রম অনুশীলন যেমনপরিবেশ সংরক্ষণ, অপচয় হ্রাস, এবং পুনর্ব্যবহারে জোর দেওয়া জরুরি।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নতি অর্জন করা, যাতে পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে। শ্রমের পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষা টেকসই উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করে, যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
শ্রমের অবমাননা
শ্রম সম্মান হানিকর নয়। শ্রমকে অস্বীকার করা মানেই নির্মল আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা এবং নিজেকে শয়তানের দোসরে পরিণত করা। একমাত্র শ্রমেতেই চিত্তশক্তি এবং আত্মার জাগরণ নিহিত।
অথচ আমাদের দেশে কায়িক শ্রমকে আজও অমর্যাদাকর বিবেচনা করা হয়। ফলে ক্রমশ আমরা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়ছি। সর্বাধিক পার্থিব উন্নতি মূলত শ্রম সামর্থ্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। কায়িক শ্রম আত্মসম্মানের পক্ষে বিন্দুমাত্র হানিকর নয়, বরং মানবসমাজে উন্নতির শ্রেষ্ঠ উপায়।
শ্রমিক লাঞ্ছনা
আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেও এখনও শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য সম্মান পাচ্ছে না। উপরন্তু তারা নানান ধরণের অত্যাচার ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। মানুষের ভুল ধারণা হলো, যারা উচ্চবিত্ত, তাদের সম্মানই বেশি। অথচ যুগ যুগ ধরে সভ্যতার প্রাচীর গড়েছে যেসব শ্রমিকেরা, তাদেরকেই পড়ে থাকতে হচ্ছে লাঞ্ছনার অন্ধকারে।
তারা পাচ্ছে না তাদের কাঙ্ক্ষিত সম্মান, ন্যায্য মূল্য ও কাজের পরিবেশ। যার ফলে আজও আমাদের দেশ উন্নতি করতে পারছে না। ধনীরা তাদের উদরপূর্তি করছে, আর শ্রমিকেরা গরিব থেকে ফকির হচ্ছে।
কর্মবিমুখ ব্যক্তির অবস্থা
শ্রম ছাড়া কোনো ব্যক্তি সাফল্যের দ্বারে পৌঁছাতে পারে না। কর্মবিমুখ ব্যক্তি তার সময়কে সঠিক পথে কাজে লাগায় না। ফলে পদে পদে সে বাধার সম্মুখীন হয়, যা তাকে সামনে যেতে দেয় না। কর্মবিমুখ মানুষেরা আজকের কাজ পরের দিনের জন্য রেখে দেয়। ফলে কাজটি আর কখনোই করা হয়ে ওঠে না।
কর্মবিমুখ ব্যক্তি সারা জীবন হতাশার মধ্য দিয়ে কাটায়। তবে সেই হতাশাকে দূর করার জন্য কাজ করতে পারে না। এই হতাশাপূর্ণ জীবন তাকে একসময় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তাই কর্মবিমুখ না থেকে পরিশ্রমের দ্বারা জীবনকে গড়ে তুলতে হবে।
সকল ধর্মে শ্রমের মর্যাদা
সকল ধর্মেই শ্রমের মর্যাদাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মে শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং শ্রমিকদের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে কর্মবাদের কথা অর্থাৎ পরিশ্রমের মাধ্যমে সৎ উপার্জনের কথা বলা হয়েছে। খ্রিষ্টধর্মে শ্রমহীন বেকার মানুষের কোনো মর্যাদা নেই।
অন্যান্য ধর্মেও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের অবস্থার পরিবর্তন অর্থাৎ উন্নতি করার কথা বলা হয়েছে। শ্রমের প্রকারভেদ বড় কথা নয়। যে কোনো শ্রমেরই গুরুত্ব ও মর্যাদা সমান।
শ্রমের জয়
শ্রমিক সমাজ দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানবিক শ্রমকে তার যোগ্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সময়ের পরিক্রমায়, একমাত্র তারাই আজ সমাজের রথকে গতিশীল করার এবং সমাজে কর্মমুখরতার ঢেউ আনার ক্ষমতা রাখে। এই কারণেই আজ চারদিকে শ্রমের জয় বিঘোষিত হচ্ছে।
বর্তমানে, সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি শ্রমিক দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট। বিভিন্ন দেশে আজ শ্রমিক সংঘ এবং শ্রমিক কল্যাণ স্বীকৃতি লাভ করেছে। সমাজ-কাব্যে উপেক্ষিত এই শ্রমকে তার ন্যায্য সম্মান না দিলে সমাজের উত্থান বা অগ্রগতি সম্ভব নয় এই সত্যটি আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
বাংলাদেশে শ্রমের স্থান
বাংলাদেশে শ্রমবিভাগ ছিল প্রধানত বর্ণগত। উঁচু বর্ণের লোকেরা সাধারণত কোনো কায়িক শ্রম করত না, আর নিম্ন বর্ণের মানুষেরা দৈহিক বা কায়িক পরিশ্রমের কাজ করত। এর ফলস্বরূপ, সমাজে একটি ধারণা জন্ম নিয়েছিল যে, যারা শারীরিক পরিশ্রম করে তারা সম্মানের পাত্র নয়।
এভাবেই কায়িক পরিশ্রম আমাদের দেশে অবজ্ঞা পেতে শুরু করে এবং এর প্রভাবে আমরা কর্মবিমুখ হয়ে পড়ি। এই মনোভাবই ছিল আমাদের অবনতির মূল কারণ।
শ্রমের সুফল
আমাদের সমাজে কোনো কাজই পরিশ্রম ছাড়া সম্পন্ন হতে পারে না। এই পৃথিবীতে সমস্ত কাজই গুরুত্বপূর্ণ। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি এবং সেই দেশ তত বেশি উন্নত। পৃথিবীর মানুষ হিসেবে আমাদের সব কাজই করা উচিত। কাজের ক্ষেত্রে যেমন কোনো ভেদাভেদ নেই, তেমনি যারা সেই কাজগুলো করেন, তাঁদের মধ্যেও কোনো জাতিভেদ থাকা উচিত নয়।
তাই পরিশ্রম করাটা কখনোই সম্মান হানিকর নয়। বরং, পরিশ্রমের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির আত্মোন্নয়ন ঘটে এবং একই সাথে দেশের কল্যাণ সাধিত হয়। শারীরিক (কায়িক) এবং মানসিক উভয় প্রকার শ্রমের মাধ্যমেই ব্যক্তি এবং জাতি গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। যে জাতি শ্রমবিমুখ, তার পতন অনিবার্য।
জগতের মহান জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা সকলেই প্রচুর পরিশ্রম করেছেন এবং শ্রমকে মর্যাদা দিয়ে গেছেন। পৃথিবীতে আমরা যত কীর্তি দেখতে পাই, তার মূলে রয়েছে মানুষের চিন্তা, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়।
শ্রমের চ্যালেঞ্জ
শ্রমিকের সামনে আসা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাগুলো অনেক বৈচিত্র্যময় ও জটিল হয়ে থাকে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মধ্যে রয়েছে ন্যায্য মজুরির অভাব, কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতা, দীর্ঘ কাজের সময়, বৈষম্য এবং হয়রানি, চাকরির অনিশ্চয়তা, এবং পেশাগত উন্নতির সীমিত সুযোগ।
প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং বিশ্বায়নের কারণে অনেক ক্ষেত্রে চাকরির সুরক্ষা আজ হুমকির মুখে। এর ফলে শ্রমিকদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানো এবং নতুন ধরনের কাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেছে।
এছাড়াও, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবের কারণে অনেক শ্রমিককেই অসুরক্ষিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
উপসংহার
জীবনের সব ক্ষেত্রে শ্রমের গুরুত্ব অসাধারণ। যদিও কোনো সমাজেই মানুষ তার পরিশ্রমের যোগ্য মর্যাদা সব সময় দেয়নি, তবুও যারা জীবনে সত্যিকারের সম্মান ও আনন্দ পেয়েছেন, তাঁরা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, পরিশ্রমেই জীবনের প্রকৃত সুখ নিহিত।
পরিশ্রমই মানুষকে জীবনের অশেষ দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ দেখায়। তাই সমাজের সকল প্রকার শ্রমকেই যথাযথভাবে মর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন।
আরো দেখুনঃ মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার রচনা ২০, ২৫ পয়েন্ট
শ্রমের মর্যাদা অনুচ্ছেদ
‘কর্মই জীবন’ এই কথাটি মানবজাতির জন্য চিরন্তন সত্য। এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া ছোট পিঁপড়ে থেকে শুরু করে প্রকাণ্ড প্রাণী পর্যন্ত, সকলকেই জীবনধারণের জন্য শ্রম বা মেহনত করতে হয়।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, আর সভ্যতার যা কিছু অগ্রগতি, আবিষ্কার বা সৌন্দর্য, তার সবই মানুষের অক্লান্ত শ্রম ও ঘামের ফল। একটি ইমারত নির্মাণ, একটি সুন্দর ছবি আঁকা, প্রযুক্তির বিস্ময়কর উদ্ভাবন সবকিছুর মূলেই রয়েছে কায়িক ও মানসিক পরিশ্রম। এক কথায়, মানুষের ও সভ্যতার সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূল ভিত্তি হলো শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা।
সাধারণ অর্থে, যেকোনো কাজ করাই হলো শ্রম। মেহনত বা দৈহিক খাটুনিই শ্রম। টিকে থাকার এই কঠিন জীবন সংগ্রামে শ্রম হলো মানুষের প্রধান হাতিয়ার। শ্রম মূলত দুই প্রকার কায়িক শ্রম যা দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করে করা হয়, যেমন দিনমজুরের কাজ, রাজমিস্ত্রীর কাজ, কৃষকের লাঙল চালানো ইত্যাদি।
অপরদিকে মানসিক শ্রম যা বুদ্ধি, চিন্তা ও মনন দিয়ে করা হয়, যেমন শিক্ষকতা, গবেষণা, শিল্পীর সৃষ্টিশীল কাজ, চিকিৎসকের কাজ ইত্যাদি। এই দুই প্রকার শ্রমের মিলিত প্রয়াসেই মানব-সভ্যতা আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। তাই, কোনো শ্রমকেই ছোট করে দেখা উচিত নয়।
জীবনে উন্নতি লাভ করতে গেলে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। অলসতা জীবনের অভিশাপ এবং সকল প্রকার দুর্গতির কারণ। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি ও দেশ তত বেশি উন্নত।
প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত পৃথিবীর যত জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞানী ও মহামানব এসেছেন, তাঁরা সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং শ্রমের মর্যাদাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বা মহাত্মা গান্ধী সকলের জীবনই ছিল পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। পরিশ্রমই মানুষকে দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে জীবনের প্রকৃত আনন্দের সন্ধান দেয়।
যে জাতি বা যে সমাজে শ্রমকে নিচু চোখে দেখা হয়, সেখানে উৎপাদনের গতি কমে আসে এবং জাতীয় সমৃদ্ধির স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। আমাদের সমাজে কায়িক শ্রম অর্থাৎ শারীরিক পরিশ্রমকে অনেকে সম্মানের চোখে দেখেন না। কিন্তু এই ধরনের শ্রমবিমুখতা একটি জাতির উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
একজন রাস্তা পরিষ্কার করা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজকেও যদি গুরুত্ব দেওয়া না হয়, তাহলে সেই সমাজের পতন অনিবার্য। শ্রমের প্রতি এই তাচ্ছিল্যই আমাদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ।
উন্নত দেশগুলোতে কাজের প্রকৃতি দেখে মানুষকে বিচার করা হয় না, বরং পরিশ্রমকে জাতীয় উন্নতির চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হয়। তাই আমাদেরও মানসিকতা পরিবর্তন করে সকল প্রকার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানো উচিত।
শ্রমই হলো জীবনের সাফল্যের মূলমন্ত্র। প্রতিটি কাজকে সমান গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রতিটি শ্রমিকের প্রতি সম্মান জানিয়েই আমরা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। মনে রাখতে হবে, “পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি” অর্থাৎ শ্রমই আমাদের সৌভাগ্য এনে দেয়। তাই, সব ধরনের শ্রমকে সম্মান জানানোর মাধ্যমেই দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব।