বাংলা ভাষার মৌলিক অংশ কয়টি? বিস্তারিত বিশ্লেষণ

ভাষা মানুষের অনুভূতি, চিন্তা, ধারণা ও আবেগ প্রকাশের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। মানুষ সমাজে বসবাস করে এবং পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ভাষার প্রয়োজন হয়। তবে একটি ভাষা কেবল কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ বা লিখে প্রকাশ করার বিষয় নয়; এটি অনেকগুলো নিয়ম, কাঠামো ও উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা। বাংলা ভাষার গঠনপ্রণালী বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে এর ভেতরে চারটি মৌলিক অংশ কাজ করে – ধ্বনি, শব্দ, বাক্য এবং অর্থ। 

প্রতিটি অংশ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং একে অন্যকে সম্পূর্ণতা প্রদান করে। এই চারটি উপাদানের একটির অনুপস্থিতিতে ভাষার পূর্ণাঙ্গতা প্রকাশ পাওয়া অসম্ভব। নিচে বাংলা ভাষার মৌলিক অংশ কয়টি ও কী কী সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

আরও পড়ুনঃ কোন আলোতে সালোকসংশ্লেষণ বেশি হয়?

বাংলা ভাষার মৌলিক অংশ কয়টি ও কী কী? 

বাংলা ভাষার মৌলিক অংশ মূলত ৪টি। যেকোনো ভাষার অভ্যন্তরীণ গঠন বিশ্লেষণ করলে এই চারটি উপাদান পাওয়া যায়, যা একটি ভাষার পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তৈরি করে। অংশগুলো নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

ধ্বনি 

ধ্বনি হলো ভাষার ক্ষুদ্রতম একক। মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত আওয়াজকেই ধ্বনি বলা হয়। তবে সব আওয়াজই ধ্বনি নয়; কেবল সেই আওয়াজই ধ্বনি হবে যা অর্থপূর্ণ শব্দ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলা ধ্বনিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে – স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি।

শব্দ 

এক বা একাধিক ধ্বনি যখন একত্রে মিলিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে শব্দ বলা হয়। শব্দকে বলা হয় ভাষার প্রাণ। ধ্বনি যদি হয় ভাষার ইট, তবে শব্দ হলো সেই ইটের তৈরি কাঠামো। ‘ক’, ‘ল’ এবং ‘ম’ এই তিনটি ধ্বনি মিলে গঠিত হয় ‘কলম’। এটি একটি নির্দিষ্ট বস্তুকে নির্দেশ করছে। কিন্তু ‘লকম’ বললে কোনো অর্থ হয় না, তাই সেটি শব্দ নয়। বাংলা শব্দভাণ্ডারকে উৎস অনুসারে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ব্যাকরণের রূপতত্ত্ব অংশে শব্দের গঠন, লিঙ্গ, বচন ও ধাতু নিয়ে আলোচনা করা হয়।

বাক্য 

কতগুলো শব্দ যখন ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী পাশাপাশি বসে বক্তার মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করে, তখন তাকে বাক্য বলে। বাক্য হলো ভাষার বৃহত্তম একক এবং যোগাযোগের মূল ভিত্তি। একটি সার্থক বাক্যের তিনটি গুণ থাকতে হয় – আকাঙ্ক্ষা, আসত্তি ও যোগ্যতা। একক শব্দ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা কঠিন, তাই বাক্যই মানুষের ভাব বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম। ব্যাকরণের বাক্যতত্ত্ব অংশে বাক্যের গঠন, পদের ক্রম এবং রূপান্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়।

অর্থ 

ভাষার চতুর্থ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো অর্থ। ধ্বনি, শব্দ বা বাক্য – সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি তার পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ না থাকে। শব্দের এবং বাক্যের মধ্যকার যে আন্তঃসম্পর্ক অর্থের সৃষ্টি করে, তাকেই অর্থতত্ত্ব বলা হয়। একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন বাক্যে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করতে পারে। ভাষার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো অর্থ পৌঁছানো। ব্যাকরণের অর্থতত্ত্ব অংশে শব্দের অর্থবৈচিত্র্য, বিপরীত শব্দ ও সমার্থক শব্দ নিয়ে আলোচনা করা হয়।

বাংলা ভাষার চারটি মৌলিক অংশ না থাকলে ভাষার কাঠামো কেমন হতো?

বাংলা ভাষার চারটি মৌলিক অংশ ধ্বনি, শব্দ, বাক্য এবং অর্থ মূলত একটি চারতলা ভবনের পিলারের মতো। যদি এর কোনো একটি অংশ না থাকতো, তবে ভাষার পুরো কাঠামোটিই ভেঙে পড়তো। ধ্বনি হলো ভাষার কাঁচামাল। যদি ধ্বনি না থাকতো, তবে ভাষা থাকতো সম্পূর্ণ স্তব্ধ। আমরা কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারতাম না। কথা বলার পরিবর্তে আমাদের কেবল ইশারা বা ছবির ওপর নির্ভর করতে হতো। ফলে ভাষা তার বর্তমান গতিশীলতা এবং প্রাঞ্জলতা হারাতো। এটি অনেকটা সুর ছাড়া গানের মতো হতো।

যদি ধ্বনি থাকতো কিন্তু কোনো শব্দ না থাকতো, তবে আমরা কেবল অর্থহীন আওয়াজ করতে পারতাম। মানুষ পশুপাখির মতো কেবল হরেক রকম আওয়াজ করে ভাব প্রকাশের চেষ্টা করতো, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো বস্তুকে নাম ধরে ডাকার উপায় থাকতো না।

শব্দ থাকলেও যদি বাক্য গঠনের নিয়ম বা কাঠামো না থাকতো, তবে ভাষা হতো এলোমেলো শব্দের স্তূপ। আমরা মনের ভাব পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করতে পারতাম না। ব্যাকরণগত শৃঙ্খলার অভাবে মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি চরমে পৌঁছাতো।

 অর্থ না সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা। ধ্বনি, শব্দ এবং বাক্য সবই থাকলো কিন্তু তার কোনো অর্থ নেই। এটি হতো অনেকটা পাগলের প্রলাপের মতো। মানুষ কথা বলতো, ব্যাকরণও হয়তো মানতো, কিন্তু কেউ কারো কথা বুঝতো না। অর্থই হলো ভাষার প্রাণ; প্রাণহীন দেহ যেমন মূল্যহীন, অর্থহীন ভাষাও তেমনই মৃত।

FAQs

শব্দ ও অর্থের পারস্পরিক সম্পর্ক কী? 

শব্দ ও অর্থের মধ্যে গভীর পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। শব্দ হচ্ছে ভাষার মৌলিক একক, যা একটি নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে। অর্থ হলো সেই ধারণা বা সংকেত যা একটি শব্দ আমাদের মনে তৈরি করে। ভাষার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দের অর্থও পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন, কিছু শব্দের আভিধানিক অর্থের পাশাপাশি তাদের প্রাসঙ্গিক অর্থও তৈরি হয় সমাজের পরিবর্তনের ফলে।

ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ও অর্থ একে অপরের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কযুক্ত?

মানুষের বাগযন্ত্র থেকে নির্গত অর্থপূর্ণ আওয়াজ বা ধ্বনি যখন নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে একত্রিত হয়, তখন তা শব্দে রূপান্তরিত হয়। শব্দ হলো ভাষার সেই একক যা কোনো নির্দিষ্ট বস্তু বা ভাবকে চিহ্নিত করে। এই শব্দগুলো যখন ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী সুবিন্যস্ত হয়ে বক্তার মনের সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করে, তখন তাকে বলা হয় বাক্য। তবে ধ্বনি থেকে শব্দ এবং শব্দ থেকে বাক্য গঠনের এই পুরো প্রক্রিয়াটি তখনই সার্থক হয়, যখন তার পেছনে একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ থাকে। অর্থই হলো ভাষার প্রাণ; অর্থহীন ধ্বনি বা অসংলগ্ন শব্দসমষ্টি কখনোই ভাষা হিসেবে গণ্য হতে পারে না।

কোনো বাক্যে অর্থের অস্পষ্টতা কেন হয়?

বাক্যের অর্থের অস্পষ্টতা মূলত ভাষাগত কাঠামোর ত্রুটি এবং প্রসঙ্গের অভাব থেকে তৈরি হয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো আভিধানিক অস্পষ্টতা, যেখানে একটি শব্দের একাধিক অর্থ থাকার ফলে শ্রোতা বিভ্রান্ত হন। আবার গঠনগত অস্পষ্টতার কারণেও অর্থ ঘোলাটে হতে পারে, যেখানে বাক্যের পদগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে যে বিশেষণটি ঠিক কাকে নির্দেশ করছে তা বোঝা যায় না।