প্রাচীন বাংলার প্রথম রাজবংশ কে প্রতিষ্ঠা করেন? গৌরবময় ইতিহাস
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলো পাল বংশ। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দী ছিল চরম অস্থিরতার সময়। গৌড়রাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় কোনো শক্তিশালী শাসক ছিল না। ফলে দীর্ঘ প্রায় ১০০ বছর বাংলায় কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। এই সময়টিকে ইতিহাসে অরাজকতার যুগ বলা হয়। এই চরম বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি পেতে বাংলার মানুষ ও সামন্তরা সম্মিলিতভাবে যাকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, তিনি হলেন রাজা গোপাল। তার প্রতিষ্ঠিত ‘পাল বংশ’ প্রায় ৪০০ বছর বাংলা শাসন করেছিল, যা বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড।
আরও পড়ুনঃ জনমত গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন কি?
প্রাচীন বাংলার প্রথম রাজবংশ কে প্রতিষ্ঠা করেন?
বাংলা অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান ও পতন ঘটেছে, তবে বাংলার ইতিহাসে প্রথম রাজবংশ হিসেবে পরিচিত হয় ‘পাল রাজবংশ’। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোপাল, যিনি প্রায় ৭০০ সালে শাসন শুরু করেন। প্রাচীন বাংলার প্রথম সফল ও স্থায়ী রাজবংশ হিসেবে পাল বংশের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। গোপাল প্রমাণ করেছিলেন যে, ঐক্যবদ্ধ শক্তির মাধ্যমে যেকোনো চরম বিপর্যয় থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মাৎস্যন্যায়ের অন্ধকার থেকে বাংলাকে আলোতে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
গোপাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠার পর, বাংলায় পাল রাজবংশের শাসনকাল প্রসারিত হতে থাকে। রাজবংশটি একে একে বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে এবং আক্রমণ প্রতিরোধ করে বাংলা অঞ্চলের ঐক্যবদ্ধতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। গোপালের ছেলে, ধর্মপাল রাজা, তাঁর পিতার উপদেশ অনুসারে শাসনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন।
মাৎস্যন্যায় কী?
পাল বংশের ইতিহাস বুঝতে হলে তার আগের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বুঝতে হবে। রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় কোনো যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিল না। ফলে ছোট ছোট অঞ্চলের ভূস্বামীরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হন। মাৎস্যন্যায় শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো ‘মাছের ন্যায় আচরণ’। পুকুরের বড় মাছেরা যেমন ছোট মাছদের গিলে ফেলে, তৎকালীন বাংলায় শক্তিশালীরা তেমনি দুর্বলদের ওপর অত্যাচার চালাত। সাধারণ মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। এই অরাজকতার অবসান ঘটাতেই বাংলার মানুষ একজন যোগ্য নেতার সন্ধান করছিলেন। আর তখনই গোপালের হাত ধরে পাল বংশের সূচনা হয়।
পাল রাজবংশের অবদান
পাল রাজবংশের সময়কাল বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি সোনালি অধ্যায়। রাজা ধর্মপাল এবং তাঁর উত্তরসূরিরা বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। এর ফলে বাংলায় বৌদ্ধ মঠ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটে। ‘নালন্দা’ ও ‘তাকশশিলা’য়ের মতো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাফল্যও পাল যুগের একটি উল্লেখযোগ্য দিক।
আধুনিক বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি গড়ে ওঠে এই সময়ে। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা এবং বৌদ্ধ দর্শনের প্রচার সাধারণ মানুষের জীবনে মৌলিক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হয়। শিল্প ও স্থাপত্য ক্ষেত্রেও তুলনামূলক উন্নতি ঘটে। এই সময়ের লোকশিল্প, পাণ্ডুলিপি এবং স্থাপত্যকলা বাংলার সাংস্কৃতিক অতীতের উন্নতির পরিচায়ক।
পাল রাজবংশের শাসকেরা প্রশাসনিক সংস্কার করতে সক্ষম হন। রাজ্য পরিচালনার জন্য সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। প্রশাসনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমগ্র রাজ্যের উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে তাঁরা বিভিন্ন অধিকার ও সুবিধা প্রদান করেন। উল্লেখযোগ্য হল, কৃষকদের নানা সুবিধা প্রদান করা হয় এবং তাঁদের মনোবল বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
পাল বংশের দীর্ঘস্থায়িত্বের রহস্য কী ছিল?
বাংলার ইতিহাসে পাল রাজবংশের প্রায় ৪০০ বছরের দীর্ঘস্থায়ী শাসন একটি বিস্ময়কর অধ্যায়। ভারতের ইতিহাসে খুব কম রাজবংশই এত দীর্ঘ সময় ধরে এককভাবে শাসন বজায় রাখতে পেরেছে। হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং যোগ্য ব্যক্তিকে ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে সম্মান জানানোই ছিল তাঁদের দীর্ঘ শাসনের মূল ভিত্তি।
পাল বংশের পতন কীভাবে হয়েছিলো?

জাতীয় ঐক্য লোপ পেলে এবং বাইরের আক্রমণ সম্ভব হলে পাল রাজবংশ পরবর্তীকালে দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলিম বর্বরদের আক্রমণ শুরু হলে পাল রাজবংশটি প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। প্রায় ৪০০ বছর দাপটের সাথে শাসন করার পর দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পাল বংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। পাল রাজাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বহিঃশত্রুর আক্রমণ এবং ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ এর ফলে তাদের ক্ষমতা কমে যায়। অবশেষে সেন বংশের উত্থানের মধ্য দিয়ে পাল রাজবংশের অবসান ঘটে।
FAQs
বাংলার ইতিহাসে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলতে কোন সময়কে বোঝানো হয়?
রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকে রাজা গোপালের ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত প্রায় ১০০ বছর বা এক শতাব্দীকাল সময়কে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলা হয়। মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে রাজা গোপাল বাংলায় সুশাসন ফিরিয়ে এনেছিলেন।
পাল রাজারা কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন?
পাল বংশের রাজারা বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান মতবাদের অনুসারী ছিলেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ও বিহার বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। পাল রাজারা বৌদ্ধ হলেও তাঁরা হিন্দু বা বৈদিক ধর্মের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। বরং তাঁরা অন্যান্য ধর্মকেও রাষ্ট্রীয়ভাবে সাহায্য করতেন।
তিব্বতি ঐতিহাসিক লামা তারনাথের মতে গোপাল কেন রাজা হয়েছিলেন?
লামা তারনাথের মতে, রাজ্যে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না এবং প্রতিদিন একজন করে রাজা মারা যেতেন। এই অরাজকতা দূর করতে চণ্ডী দেবীর আশীর্বাদে গোপাল রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন এবং শান্তি ফিরিয়ে আনেন।
পাল বংশের শেষ শক্তিশালী রাজা কে ছিলেন?
পাল বংশের শেষ শক্তিশালী ও যোগ্য শাসক হিসেবে রামপাল (১০৭৭-১১২৪ খ্রিস্টাব্দ) ইতিহাসের পাতায় উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছেন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল পাল বংশের ক্ষয়িষ্ণু গৌরবকে পুনরজ্জীবিত করার একটি শেষ ও সফল প্রচেষ্টা। তাঁর মৃত্যুর পর পাল বংশ দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয়।
পাল রাজারা কি শুধু বাংলারই শাসক ছিলেন?
না। ধর্মপাল এবং দেবপাল প্রমাণ করেছিলেন যে, বাংলা কেবল নদীমাতৃক শান্ত জনপদ নয়, বরং এখান থেকেই পুরো উত্তর ভারত শাসনের ক্ষমতা রাখা সম্ভব। তাঁদের সময়ে পাল সাম্রাজ্য বিহার থেকে শুরু করে উত্তর ভারতের বিশাল সমভূমি পর্যন্ত এমনভাবে বিস্তৃত ছিল যে, হিমালয় থেকে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত তাঁদের জয়ধ্বনি শোনা যেত।
পরিশেষে
পাল রাজবংশ প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। গোপালের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এই রাজবংশ বাংলা অঞ্চলে সুশাসন, বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের একটি নতুন সুযোগ এনে দেয়। পাল রাজবংশের শাসনকাল বাংলার ইতিহাসে ইতিহাসের গর্বিত অধ্যায় রচনা করে, যেখানে মানুষের জীবনযাত্রা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক উন্নতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে।