কৃষি কাজে বিজ্ঞান রচনা ১০, ২০ পয়েন্ট (সকল শ্রেণী ২০২৬)
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় আমরা কৃষি কাজে বিজ্ঞান রচনাটি ২০টি পয়েন্টের মাধ্যমে তোমাদের সামনে তুলে ধরব। আমাদের জীবনধারণের জন্য খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই, আর এই খাদ্যের প্রধান উৎস হলো কৃষি। এ কারণেই যুগ যুগ ধরে কৃষিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা ও সমাজ।
শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষায় কিংবা লেখার প্রয়োজনে ‘কৃষি কাজে বিজ্ঞান রচনা ২০ পয়েন্ট’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই রচনার মাধ্যমে তোমরা শুধু পরীক্ষার প্রস্তুতিই নিতে পারবে না, বরং কৃষি ও বিজ্ঞানের গভীর সম্পর্কটিও স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারবে। তোমাদের সুবিধার্থে নিচে কৃষিকাজে বিজ্ঞান রচনাটি ২০টি পয়েন্টে দেওয়া হলো
আরো দেখুনঃ ছাত্র জীবন রচনা ২০ ও ২৫ পয়েন্ট
ভূমিকা
মানুষের জীবনে প্রধান চাহিদার মধ্যে খাদ্য সর্বাগ্রে প্রথম স্থান অধিকার করে। অন্ন বা খাদ্য ছাড়া জীবনধারণ কল্পনাও করা যায় না। আর এই অন্ন উৎপাদনের প্রধান উৎস হলো কৃষিকাজ। তাই যথার্থই বলা হয়, কৃষিই হলো জীবনের মূল ভিত্তি।
অতীতে কৃষিকাজ ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং ফলন ছিল সীমিত। কৃষকরা কেবল নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং প্রজন্ম থেকে পাওয়া প্রথাগত জ্ঞানের উপর নির্ভর করে ফসল উৎপাদন করতেন। ফলে কখনও ভালো ফলন হতো, আবার কখনও হতো না। খরা, বন্যা বা পোকামাকড়ের আক্রমণে অনেক সময় মাঠের সব ফসল নষ্ট হয়ে যেত, যার ফলস্বরূপ মানুষের মধ্যে দেখা দিত দুর্ভিক্ষ।
কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান যখন কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করল, তখন থেকে কৃষির চেহারাটাই সম্পূর্ণ বদলে গেল। বিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী অবদান কৃষককে এনে দিয়েছে নতুন আশার আলো এবং নিশ্চিত ফলনের ভরসা।
কৃষি বিজ্ঞানের জনক
কৃষি বিজ্ঞানের জনক হিসেবে সর্বজনীনভাবে ড. নরম্যান বোর্লাউ-কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঘটে যাওয়া ‘সবুজ বিপ্লবের’ অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ। বোর্লাউ উচ্চ ফলনশীল ও রোগপ্রতিরোধী গমের নতুন জাত উদ্ভাবন করেন। তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কার মেক্সিকো, ভারত এবং পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদনকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বিশ্বব্যাপী খাদ্যের অভাব দূরীকরণে এই অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৭০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশেও তাঁর গবেষণার প্রভাব সুদূরপ্রসারী; যেখানে উচ্চ ফলনশীল ধান ও গমের জাত কৃষকদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তবে, বোর্লাউয়ের কৃষি পদ্ধতি, বিশেষত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার, পরিবেশ এবং টেকসই কৃষি নিয়ে কিছুটা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তবুও, তাঁর এই অবদান কৃষিকে বিজ্ঞানের সাথে সমন্বিত করে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে, যা কৃষকদের জীবন এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। নরম্যান বোর্লাউয়ের কাজই আধুনিক কৃষি বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
কৃষি ও সভ্যতা
মানব সভ্যতার সূচনা হয়েছিল কৃষির হাত ধরেই। প্রাচীনকালে মানুষ ছিল যাযাবর—তারা শিকার করে, ফলমূল কুড়িয়ে অথবা মাছ ধরে জীবনধারণ করত। ফলে তাদের জীবন ছিল অস্থির ও অনিশ্চিত। কিন্তু যখন মানুষ কৃষির কৌশল আবিষ্কার করল, তখনই তারা প্রথম স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে।
জমি পরিষ্কার করে চাষ করা, বীজ বপন করা, সেচ দেওয়া এবং ফসল সংগ্রহের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারল যে শস্য উৎপাদন করে নিজেদের ক্ষুধা নিবারণ করা সম্ভব। এই কৃষির কল্যাণেই মানুষ স্থায়ী জীবন, গ্রাম, নগর এবং রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। তাই সভ্যতার অগ্রযাত্রায় কৃষির অবদান অপরিসীম।
কৃষির তাৎপর্য
কৃষির গুরুত্ব কেবল খাদ্য উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। আমরা যে ভাত খাই তা আসে ধান থেকে, রুটি পাই গম থেকে; ডাল, শাকসবজি এবং তেলবীজ সবই আসে কৃষির মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, আমাদের পোশাকের কাঁচামাল তুলা, পাট ও রেশমও কৃষিজাত পণ্য।
আমাদের দেশের শিল্প-কারখানার একটি বড় অংশই কৃষিভিত্তিক। কাগজ কল, চিনি কল, তেল কল এবং পাটকলের মতো শিল্পগুলো সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি শুধু খাদ্য ও কাঁচামালই সরবরাহ করে না, এটি জাতীয় অর্থনীতিকেও সচল রাখে। গ্রামীণ সমাজকে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে কৃষি দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করে।
কৃষি ও কৃষিকাজ
মাটি কর্ষণ করে ফসলের সম্ভার ফলানোর প্রক্রিয়াটিই কৃষিকাজ নামে পরিচিত। আদিকালে মানুষ মূলত অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের প্রয়োজনে কৃষিকাজের উদ্ভাবন করেছিল। প্রকৃতির দানকে নিজের শক্তি ও সৃষ্টিক্ষমতার মাধ্যমে রূপান্তর ঘটিয়ে সে গড়ে তুলেছে এই কৃষি ব্যবস্থা।
কৃষির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল মুখে আহার জোটানো। তবে পরবর্তীতে মানুষ শিল্প কাঁচামাল থেকে শুরু করে জীবনের প্রায় সকল প্রকার উপকরণ কৃষি থেকেই সংগ্রহ করতে শিখেছে।
শিল্পযুগে প্রবেশ করার পর কৃষিক্ষেত্রেও মানুষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও উপকরণের ব্যবহার শুরু করেছে। এর ফলে, আজ ভোঁতা কর্ষণ সামগ্রী ও পশুশক্তির পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। আদিম এই পেশাটিতে এখন এসেছে বৈচিত্র্য ও গতিশীলতার ছোঁয়া।
কৃষিকাজের গুরুত্ব
কৃষিকাজ দিয়েই মানুষ পৃথিবীতে স্ব-পোষিত অর্থনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, এবং আজও মানবজীবনের ধারা প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভর করেই বয়ে চলেছে। সারা বিশ্বের মানুষের খাদ্য, পোশাক, শিক্ষা উপকরণ, বাসস্থান ও অবকাঠামোগত উপকরণের প্রধান যোগানদাতা হলো কৃষি। বর্তমানে বিশ্বের মোট আয়ের প্রায় ২৭ ভাগ আসে কৃষি খাত থেকে।
মানুষের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন বিবেচনা করে কৃষিক্ষেত্রে অনবরত গবেষণা চলছে। এর ফলস্বরূপ, উন্নত দেশগুলো তাদের কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। ফলন বহুগুণ বাড়িয়ে উন্নত দেশগুলো একদিকে যেমন নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করছে, তেমনি অন্যদিকে খাদ্য ঘাটতিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করে মানবজাতিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করছে।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রভাব
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রভাব সত্যিই বিস্ময়কর। আগে যেখানে এক বিঘা জমিতে মাত্র ৮-১০ মণ ধান উৎপাদন হতো, সেখানে এখন বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে ফলন ২৫-৩০ মণ পর্যন্ত পৌঁছেছে। সেচ প্রযুক্তির কারণে খরার সময়েও ফসল বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি সার জমির উর্বরতা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে।
অন্যদিকে, আধুনিক কীটনাশক ফসলকে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগ থেকে রক্ষা করছে। এছাড়াও, ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, ধান কাটা যন্ত্র এবং হারভেস্টারের মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি কৃষকের শ্রমকে সহজ করেছে এবং উৎপাদন বাড়িয়েছে বহুগুণ। কৃষিক্ষেত্রে এই সমস্ত বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের অমূল্য অবদানের কারণেই।
কৃষি গবেষণায় বিজ্ঞান
কৃষিক্ষেত্রে নিরন্তর গবেষণা বিজ্ঞানকে আরও শক্তিশালী করেছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেমন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI), এবং বিএডিসি (BADC) আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে উন্নত জাতের ধান, গম, ভুট্টা, সবজি ও ফল উদ্ভাবন করেছে।
এই নতুন উদ্ভাবিত ফসলগুলো কম সময়ে বেশি ফলন দেয়, রোগ প্রতিরোধী এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি সহনশীল। গবেষণার মাধ্যমেই হাইব্রিড জাতের বীজও তৈরি হয়েছে, যা দেশের কৃষিতে সত্যিকারের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
কৃষিতে বিজ্ঞানের দান
কৃষিতে বিজ্ঞানের অবদান সত্যিই অসংখ্য। আজকের কৃষকরা আর হাতে লাঙল নিয়ে নয়, বরং আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জমি চাষ করছেন। উন্নত বীজ ব্যবহারের ফলে কৃষি আজ বেশি ফলন দিচ্ছে। রাসায়নিক সার মাটির উর্বরতা বাড়িয়েছে বহুগুণ।
আধুনিক সেচ ব্যবস্থা খরাপ্রবণ অঞ্চলেও ফসল উৎপাদন সম্ভব করেছে। এছাড়া, রোগ প্রতিরোধক ঔষধ ব্যবহার করে ফসলকে পোকামাকড় ও বিভিন্ন ব্যাধি থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। এক কথায় বলা যায়, বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কার কৃষিকে করেছে আরও বেশি সমৃদ্ধ ও ফলনশীল।
কৃষি কাজে বিজ্ঞানের প্রয়োজন
পৃথিবীতে জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অথচ কৃষি জমি বাড়ছে না। বরং বাড়িঘর ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে কৃষি জমি ক্রমশ কমে আসছে। অন্যদিকে, সনাতন চাষাবাদের ফলে উৎপাদনও সেই হারে বাড়ছে না। বিশেষ করে আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রাচীন পদ্ধতির চাষাবাদের কারণে উৎপাদিত ফসল বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।
এর বিপরীতে, উন্নত দেশগুলোতে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে উৎপাদন অনেক বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে, আমাদের দেশেও মানুষের খাদ্যাভাব পূরণের জন্য কৃষিকাজে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান
বর্তমানে আমাদের দেশের কৃষিকাজেও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। যদিও জমির খণ্ডবিখণ্ডতার কারণে ট্রাক্টরের মতো যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার এখনও সম্ভব হয়নি। তবে কৃষকরা এখন আর বৃষ্টির জন্য চাতকের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন না।
সেচের জন্য এখন গভীর নলকূপ এবং মেশিনচালিত পাম্প ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, ভালো ফলনের জন্য উন্নত মানের বীজ বপন করা হচ্ছে এবং বীজ সংরক্ষণেও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।
রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনের মাত্রা বাড়ানো হচ্ছে।
বিজ্ঞানের সহায়তায় আগে যেখানে এক ধরনের ফসল ফলানো যেত, এখন সেখানে বছরে তিন ধরনের ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। তবে, এটা মানতেই হবে যে আমাদের দেশের কৃষিকাজ এখনও সম্পূর্ণ যান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি। এটা নিশ্চিত যে, চাষাবাদে বিজ্ঞানকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলে আমাদের খাদ্য সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।
বিভিন্ন দেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান
কৃষিকাজে বিজ্ঞান আজকের উন্নত বিশ্বের চালিকাশক্তি। জমি প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে বীজ বপন, সেচ, ফসল কাটা, মাড়াই ও বাছাই সব কাজই এখন সম্পূর্ণভাবে যন্ত্রনির্ভর। ট্রাক্টরের সাহায্যে জমি কর্ষণ করা হয় এবং স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে জমিতে বীজ বপন করা হয়।
এমনকি বপনের জন্য বীজ বাছাইয়ের কাজও যন্ত্রের সাহায্যে করা হয়ে থাকে। ফসলের যত্নেও বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। জমিতে পরিমাণমতো সার দেওয়া এবং ফসলে পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে ওষুধ স্প্রে করার কাজও যন্ত্র দিয়ে করা হয়। আজকের কৃষকেরা সেচের জন্য আর আকাশের মুখাপেক্ষী নন।
অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি এখন আর শস্য উৎপাদনের বাধা নয়; গভীর নলকূপ এবং পাম্পের সাহায্যে জমিতে প্রয়োজনমতো সেচ দেওয়া হয়। ফসল তোলার ক্ষেত্রেও এসেছে অত্যাধুনিক পদ্ধতি। ফসল কাটা যন্ত্র একদিকে যেমন ফসল কাটে, তেমনি অন্যদিকে মাড়াই হয়ে শস্য ও খড় পৃথক করে দেয়। উন্নত দেশগুলি এভাবে কৃষিকাজকে সম্পূর্ণরূপে যান্ত্রিক করে তুলেছে।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের ব্যবহার
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনের সকল স্তরেই বিজ্ঞানের প্রয়োগ করে চাষাবাদ করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে প্রাচীনকালের কাঠের লাঙল, বলদ, মই, নিড়ানি, কোদাল, কাস্তে ইত্যাদির বদলে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়।
যেমন: জমি চাষের জন্য ব্যবহার করা হয় ট্র্যাক্টর ও পাওয়ার টিলার, বীজ বপনের জন্য রয়েছে সিডলিং মেশিন, জমি সমান করার জন্য ব্যবহার করা হয় লেভেলার, পানি সেচের জন্য রয়েছে গভীর ও অগভীর নলকূপ এবং পাওয়ার পাম্প, আগাছা পরিষ্কারের জন্য ব্যবহার করা হয় উইডার, ফসল সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হয় হারভেস্টার এবং ফসল মাড়াইয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় থ্রেসার।
এভাবে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষি কাজকে আরও উন্নত ও সহজ করে তোলা যায়।
কৃষিকার্যে বিজ্ঞানের সফল প্রয়োগ
বাংলাদেশের কৃষিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বিজ্ঞানের সফল প্রয়োগ নিশ্চিত করা আবশ্যক। এর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি যথা কৃষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে, গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে, কৃষকদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে, পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে এবং কৃষকদের বৈজ্ঞানিক কৃষি পদ্ধতির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। এই পদক্ষেপগুলি কার্যকর করা গেলেই দেশের কৃষি সত্যিকার অর্থে যুগোপযোগী হয়ে উঠবে।
কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তি
তথ্য প্রযুক্তি কৃষিকে আধুনিক ও তথ্যভিত্তিক করে তুলেছে। মোবাইল অ্যাপ, ওয়েবসাইট এবং এসএমএস সেবার মাধ্যমে কৃষকরা এখন সহজেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস, বাজার মূল্য এবং কৃষি পরামর্শ পেয়ে থাকে। বিশেষত, বাংলাদেশে কৃষি তথ্য সেবা কৃষকদের ফসল ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কৃষকরা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে তাদের ফসলের রোগও শনাক্ত করতে পারে। এভাবে তথ্য প্রযুক্তি কৃষকদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে এবং ফসলের ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়।
তবে, এই প্রযুক্তির প্রসারে কিছু বাধা রয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সুবিধার অভাব এবং ডিজিটাল শিক্ষার ঘাটতি এই পথে প্রধান অন্তরায়। তাই, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তি কৃষিকে আরও লাভজনক ও টেকসই করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি
জলবায়ু পরিবর্তন কৃষির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা খরা, বন্যা, লবণাক্ততা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিজ্ঞান এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞান খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসল উদ্ভাবন করেছে, যেমন ব্রি ধান ৭৮, যা বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ড্রিপ সেচ-এর মতো প্রযুক্তিগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে সহায়তা করে।
তবে, কৃষকদের জন্য সমস্যা হলো এই প্রযুক্তির উচ্চ খরচ এবং সহজলভ্যতার অভাব। এই বাধাগুলি অতিক্রম করার জন্য সরকারি নীতি, গবেষণা এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ জলবায়ু সহনশীল কৃষি পদ্ধতির প্রচারে সহায়তা করতে পারে। এভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিজ্ঞান কৃষির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করছে।
কৃষি শিক্ষার গুরুত্ব
কৃষি শিক্ষা কৃষকদের বিজ্ঞানের সঠিক প্রয়োগে দক্ষ করে তোলে। বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং সম্প্রসারণ বিভাগগুলি কৃষকদের উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক এবং যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
এই শিক্ষা কৃষকদের ফসল ব্যবস্থাপনা, মাটি পরীক্ষা এবং টেকসই পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান দেয়। এর একটি উদাহরণ হলো সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) প্রশিক্ষণ, যা কীটনাশকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সাহায্য করেছে।
তবে, গ্রামীণ কৃষকদের কাছে শিক্ষার প্রসার এখনও সীমিত। এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল প্রযুক্তি কৃষি শিক্ষার প্রচারে সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে। সঠিক কৃষি শিক্ষা কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
কৃষি অর্থনীতিতে বিজ্ঞান
বিজ্ঞান কৃষি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলেছে। উচ্চ ফলনশীল ফসল, যান্ত্রিকীকরণ এবং তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কৃষকদের উৎপাদন এবং আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে ধান, পাট এবং সবজি রপ্তানি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এছাড়া, মাইক্রোফাইন্যান্স এবং কৃষি ঋণ কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে সহায়তা করছে।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের ক্ষতিকর দিক
আধুনিক কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের পরিবেশের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনছে। এই রাসায়নিকগুলো মাটির উর্বরতা ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে। একই সাথে, এগুলো পানি ও বায়ু দূষণ সৃষ্টি করছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসের মতো উপাদান যখন অতিরিক্ত পরিমাণে জলাশয়ে যায়, তখন তা সেখানে থাকা জলজ প্রাণী এবং সেই পানি ব্যবহারকারী মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। জেনেটিকালি মডিফায়েড (GM) ফসল নিয়েও পরিবেশ ও স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত নানা বিতর্ক রয়েছে। এই ফসলগুলো নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন মত দেখা যায়।
পাশাপাশি, কৃষিকাজে যান্ত্রিকীকরণের ফলে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে, কৃষি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এছাড়া, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। এটি ভবিষ্যৎ কৃষির জন্য একটি বড় হুমকি।
উপসংহার
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো কৃষি, আর এই আধুনিক কৃষির প্রাণ হলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের স্পর্শে বাংলাদেশের কৃষি এখন এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। আমরা ইতিমধ্যেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছি।
ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিকে আরও বেশি সমৃদ্ধশালী করে তোলা। যাতে দেশে খাদ্য চাহিদা মেটানোর পর যে বাড়তি ফসল থাকবে, তা আমরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারি। এর ফলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
তাই দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে, বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিই পারে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী কৃষি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে।