তিন বিঘা করিডোর কোন জেলায় অবস্থিত? বিস্তারিত আলোচনা
তিন বিঘা করিডোর কেবল ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৮৫ মিটার প্রস্থের একটি সামান্য ভূখণ্ড নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে একটি দীর্ঘস্থায়ী ভূ-রাজনৈতিক লড়াই, কূটনৈতিক জয় এবং হাজার হাজার মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক। বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার শেষ প্রান্তে অবস্থিত এই করিডোরটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার মেকলিগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা নামক দুটি বৃহৎ ছিটমহলকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করার একমাত্র পথ এই তিন বিঘা করিডোর।
আরও পড়ুনঃ প্রবন্ধ রচনা লেখার নিয়ম
করিডোর কী?
‘করিডোর’ শব্দটি মূলত একটি সংকীর্ণ দীর্ঘ পথ বা এলাকাকে বোঝায় যা দুটি ভিন্ন ভৌগোলিক স্থান বা ভূখণ্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। রাজনীতি বা ভূগোলের ভাষায়, করিডোর হলো একটি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন বা লিজ নেওয়া এমন একটি সরু ভূখণ্ড, যা একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করার জন্য অন্য একটি রাষ্ট্রের ওপর দিয়ে চলে গেছে। বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ বা ছিটমহলকে মূল ভূখণ্ডের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য এই পথ ব্যবহৃত হয়। যেমন, তিন বিঘা করিডোর। করিডোরের প্রস্থ এবং দৈর্ঘ্য সাধারণত সীমিত হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন, অর্থনীতি ও যোগাযোগে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
তিন বিঘা করিডোর সম্পর্কে
দহগ্রাম এবং আঙ্গরপোতা ছিল বাংলাদেশের এমন দুটি বড় ছিটমহল যা ভারতের ভূখণ্ড দ্বারা চারপাশ থেকে বেষ্টিত ছিল। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে এদের দূরত্ব ছিল মাত্র কয়েকশ গজ, কিন্তু মাঝে ভারতের ভূখণ্ড থাকায় এই এলাকার মানুষ কার্যত বন্দি জীবনযাপন করতেন।
১৯৫৩ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এই ছিটমহল নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল ভারতের বেরুবাড়ী দক্ষিণ ভাগ পাওয়ার বিনিময়ে তারা বাংলাদেশকে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা ছিটমহলের সাথে সংযোগের জন্য ‘তিন বিঘা করিডোর’ লিজ দেবে।
তিন বিঘা করিডোর কোন জেলায় অবস্থিত?
বর্তমানে তিন বিঘা করিডোর কেবল একটি পথ নয়, এটি একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত মানুষ এই করিডোর দেখতে লালমনিরহাটে যান। করিডোর গেটে বিএসএফ এবং বিজিবি সদস্যদের প্যারেড ও কড়া পাহারা পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
তিন বিঘা করিডোর কেন ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ?
তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশের একটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং ছিটমহল সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই করিডোরের মাধ্যমে ভারতের ভেতরে অবস্থিত বাংলাদেশের দহগ্রাম–আঙ্গরপোতা ছিটমহল বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পায়। ফলে এটি শুধু ভৌগোলিক নয়, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও মানবিক দিক থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি স্থাপনা হিসেবে ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
তিন বিঘা করিডোর ইজারা দেওয়ার আগে দহগ্রাম আঙ্গরপোতার মানুষের কী ধরনের সমস্যা ছিল?
তিন বিঘা করিডোর ইজারা দেওয়ার আগে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা ছিটমহলের মানুষদের জীবন ছিল অত্যন্ত দুর্বিষহ ও সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে তারা নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতো। যাতায়াতের তীব্র সংকট ছিল। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে যেতে হলে ভারতের ভেতর দিয়ে বিশেষ অনুমতি নিয়ে চলাচল করতে হতো, যা সব সময় সহজ ছিল না।
শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার অভাব ছিল মারাত্মক। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে যেতে পারত না সহজে। ফলে অনেক শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো এবং অসুস্থ রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা পেত না। প্রশাসনিক সেবার অভাব ছিল। একইসাথে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সমস্যা ছিল প্রবল। তিন বিঘা করিডোর ইজারা দেওয়ার পর তাদের জীবনযাত্রায় যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
তিন বিঘা করিডোর খোলা থাকার সময়সূচি কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল?

করিডোরটি ভারত সরকারের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে থাকায় উভয় দেশই এটি ব্যবহার করার নিয়মাবলী ঠিক করেছিল। সাধারণভাবে নির্ধারিত হয়েছিল, যে করিডোরটি দিনের নির্দিষ্ট সময়ে খোলা থাকবে, যাতে মানুষ নিরাপদভাবে যাতায়াত করতে পারে। এছাড়াও সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতীয় প্রহরী এবং বাংলাদেশি প্রতিনিধি উভয়ই সময়সূচি ও ব্যবহারের নিয়ম অনুসরণ করতেন।
সাধারণভাবে, দিনের আলো থাকাকালীন সময়ে করিডোর খোলা রাখা হতো, যাতে যাতায়াত সুবিধাজনক ও ঝুঁকিমুক্ত হয়। এছাড়াও বিশেষ ছুটির দিন বা সরকারি কার্যক্রমের সময়ে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হতো।
FAQs
কোন সালে তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশকে ইজারা দেওয়া হয়?
তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশকে ইজারা দেওয়া হয় ১৯৯২ সালে। ইজারা দেওয়ার আগে দহগ্রাম – আঙ্গরপোতার মানুষদের ভারতের ভেতর দিয়ে বিশেষ অনুমতি নিয়ে চলাচল করতে হতো, যা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর ও অনিশ্চিত। শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কাজে তারা মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হতো। ১৯৯২ সালে তিন বিঘা করিডোর খুলে দেওয়ার ফলে এই দীর্ঘদিনের মানবিক সংকট অনেকটাই লাঘব হয়।
তিন বিঘা করিডোর কোন জেলার কোন উপজেলার কাছে অবস্থিত?
তিন বিঘা করিডোর লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার কাছে অবস্থিত।এটি পাটগ্রাম উপজেলার অন্তর্গত দহগ্রাম আঙ্গরপোতা ছিটমহলকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে। করিডোরটি ভারতের কোচবিহার জেলার ভেতর দিয়ে গেছে, তবে এর ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য ইজারাভিত্তিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কেন গুরুত্বপূর্ণ?
তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের ইতিহাসে বন্ধুত্বপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতীক হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এই করিডোর প্রমাণ করে যে সীমান্তসংক্রান্ত জটিল সমস্যা সংঘাত নয়, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। ফলে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং ভবিষ্যতে সীমান্ত চুক্তি ও ছিটমহল সমস্যার সমাধানের পথ সুগম হয়।
পরিশেষে
তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশের মানচিত্রে কেবল একটি সরু সংযোগ পথ নয়, এটি সার্বভৌমত্বের মর্যাদা এবং দীর্ঘ বঞ্চনার অবসানের প্রতীক। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার এই ছোট ভূখণ্ডটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সুষ্ঠু কূটনৈতিক আলোচনা ও বন্ধুত্বের মাধ্যমে যেকোনো কঠিন আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব। আজ দহগ্রাম আঙ্গরপোতার মানুষ যে স্বাধীন জীবনযাপন করছেন, তার মূলে রয়েছে এই তিন বিঘা করিডোর। এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক অনন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।