কুমারী পূজা কেন করা হয়? কীভাবে করা হয় এই পূজা?

দুর্গোৎসবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হলো কুমারী পূজা, যা ঘিরে মানুষের আগ্রহ ও কৌতূহল বরাবরই ব্যাপক। ভারত ও বাংলাদেশসহ রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন কেন্দ্র এবং অনেক ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে অষ্টমী তিথিতে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার চেতনাকে জাগ্রত করতেই এ আচার পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হিন্দুধর্মে নারীকে মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে, আর কুমারী পূজা সেই বিশ্বাসেরই প্রতীক।

মতানুসারে প্রাচীন মুনি ঋষিরা প্রকৃতিকে নারীর সঙ্গে তুলনা করতেন, তাই কুমারী পূজার মাধ্যমে তারা প্রকৃতির আরাধনাই করতেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই বিরাজ করেন, বিশেষ করে যাদের মন কলুষমুক্ত ও সরল, তাদের মধ্যেই ভগবানের উপস্থিতি সবচেয়ে স্পষ্ট। এই নির্মলতার প্রতীক হিসেবে কুমারীদের দেখা হয়, তাই তাদের দেবীরূপে পূজা করা হয়। দেবীপুরাণেও কুমারী পূজার উল্লেখ রয়েছে এবং শাস্ত্র অনুসারে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী বালিকাদের কুমারী হিসেবে পূজা করা হয়।

আরও পড়ুনঃ তিন বিঘা করিডোর কোন জেলায় অবস্থিত? 

কুমারী পূজা কেন করা হয়? 

শারদীয় দুর্গোৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো কুমারী পূজা। মহাষ্টমী বা মহানবমীর ভোরে যখন ঢাকের শব্দে চারপাশ মুখরিত হয়, তখন প্যান্ডেলে বা মঠে একটি ছোট মেয়েকে দেবীর সাজে সিংহাসনে বসানো দেখে সবার মনে ভক্তি ও কৌতূহল উভয়ই জাগে। ১৬ বছরের কম বয়সী কুমারী কন্যাকে সাক্ষাৎ মা দুর্গার প্রতিনিধি হিসেবে পূজা করার এই রীতি হিন্দুধর্মের এক অনন্য দর্শনকে তুলে ধরে।

কুমারী পূজা বর্তমান সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও নারী নির্যাতনের মতো জটিল বাস্তবতার মাঝেও আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রতিটি কন্যাশিশুই শক্তি, সম্ভাবনা ও মর্যাদার প্রতীক। এটি মানুষের মধ্যে সমতা ও সৌহার্দ্যের বোধ জাগ্রত করে, সামাজিক ভেদাভেদ দূর করে সবার মাঝে একাত্মতার সেতুবন্ধন গড়ে তোলে। একই সঙ্গে মাতৃত্বের মহিমা ও নারীত্বের গৌরব তরুণ প্রজন্মের সামনে উজ্জ্বলভাবে উপস্থাপন করে।

কুমারী পূজা কী? 

কুমারী পূজা হলো সনাতন ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার যেখানে একজন অল্পবয়সী কন্যাকে দেবীর প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে, নারীকে শক্তির প্রতিমূর্তি ধরা হয় এবং দেবী দুর্গার প্রতিফলন মানুষের মধ্যেই বিরাজমান এই বিশ্বাস থেকেই কুমারী পূজার সূচনা। এই পূজার মাধ্যমে বিশ্বাস করা হয় যে, নারীর মধ্যে বিরাজমান ঈশ্বরীয় শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি মানুষের অন্তরের পশুত্ব, লোভ, হিংসা ও অশুভ প্রবৃত্তিকে দমন করার শিক্ষা দেওয়া হয়। বর্তমান সমাজে নারী নিগ্রহ বা অবমাননা প্রতিরোধের একটি আধ্যাত্মিক হাতিয়ার হলো কুমারী পূজা। এক জন কুমারীকে দেবী জ্ঞানে পূজা করার অর্থ হলো সমাজের প্রতিটি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাদের মাতৃজ্ঞানে দেখা।

পূজার পূর্বে কুমারী কন্যাকে স্নান করিয়ে পরিষ্কার পোশাক পরানো হয় এবং পূজার আসনে বসিয়ে দেবীর রূপে কল্পনা করে আরতি, পুষ্পাঞ্জলি ও বিভিন্ন আচার সম্পন্ন করা হয়। তার পা ধুয়ে প্রসন্নতা কামনা করা হয়, কারণ হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করা হয় নিষ্পাপ জীবনের কারণে কুমারী শিশু দেবীত্ব ও পবিত্রতার সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে থাকে।

কুমারী পূজার প্রচলন কীভাবে হয়? 

কুমারী পূজার প্রচলন নিয়ে দেবী ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণে চমৎকার কাহিনী রয়েছে। পুরাণমতে, এক সময় বাণাসুর নামক এক প্রতাপশালী অসুর স্বর্গরাজ্য দখল করে নেয়। দেবতারা নিরুপায় হয়ে মহাশক্তির আরাধনা শুরু করেন। বাণাসুরের বর ছিল যে, কেবল একজন কুমারী কন্যার হাতেই তার মৃত্যু হবে।

তখন দেবী দুর্গা এক কুমারী কন্যার রূপ ধারণ করেন এবং বাণাসুরকে যুদ্ধে পরাজিত ও বধ করেন। এই ঘটনার স্মরণে এবং কুমারী রূপী দেবীর অসীম শক্তিকে পূজা করার জন্যই কুমারী পূজার প্রথা শুরু হয়। এছাড়া তান্ত্রিক সাধনায় কুমারী পূজা সিদ্ধিলাভের একটি অন্যতম পথ হিসেবে স্বীকৃত।

কুমারী পূজা কীভাবে করা হয়? 

How is Kumari Puja performed

কুমারী পূজার আচারটি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। নির্ধারিত দিনে ভোরবেলা নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন লাল শাড়ি, হাতে আলতা, কপালে সিঁদুরের টিপ এবং মাথায় ফুলের মুকুট পরিয়ে দেবীর রূপে সজ্জিত করা হয়। এরপর তাকে সুন্দরভাবে সাজানো সিংহাসনে বসানো হয় এবং পায়ের নিচে রাখা হয় পদ্মফুল। 

পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে কুমারীর মধ্যে দেবীশক্তির আবাহন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং পূজা সম্পন্ন করেন। শেষে ধূপ দীপ জ্বালিয়ে আরতি করা হয়, আর পূজা শেষে ভক্তেরা তার পায়ে প্রণাম ও পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে।

FAQs

কেন কুমারীকে দেবীর প্রতীক হিসেবে ধরা হয়?

সনাতন ধর্মীয় দর্শনে নারীকে শক্তির আধার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, আর কুমারী সেই শক্তির নির্মল রূপকে বোঝায়। একটি কুমারী কন্যা ভবিষ্যৎ মাতৃত্বের ধারণা বহন করে। তাই তাকে কেবল একজন মানুষ হিসেবে নয়, শক্তি ও দেবীসত্তার প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়। 

কুমারী পূজা মানুষের মধ্যে কোন মূল্যবোধ জাগ্রত করে?

কুমারী পূজা মানুষের মধ্যে মূলত নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও নৈতিক সচেতনতা জাগ্রত করে। এই পূজার মাধ্যমে বোঝানো হয় যে নারী শুধুই ভোগ্যবস্তু নয়, বরং তিনি শক্তি, সৃষ্টি ও মর্যাদার প্রতীক। ফলে এটি মানুষকে নারীকে সম্মান করা, মূল্য দেওয়া এবং সামাজিকভাবে তাকে নিরাপদ ও মর্যাদাবান করার শিক্ষা দেয়। 

কুমারী পূজার সঙ্গে দেবী দুর্গার কী সম্পর্ক রয়েছে?

কুমারীকে দেবীর প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, বিশেষ করে দেবী দুর্গার কারণ কুমারীর মধ্যে নির্মলতা, পবিত্রতা এবং শক্তির ধারণা প্রতিফলিত হয়, যাকে দুর্গার শক্তি ও ক্ষমতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। কুমারী পূজার মাধ্যমে মানুষ দুর্গার সেই শক্তিকে জীবন্ত রূপে সম্মান করে, যেন শিশু কন্যার মধ্যেই দেবীর শক্তি উপস্থিত থাকে। 

পরিশেষে

কুমারী পূজা কেবল একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি জীবনদর্শন। এটি আমাদের শেখায় কীভাবে রক্ত মাংসের মানুষের ভেতরে ঈশ্বরের মহিমা খুঁজে পেতে হয়। যে সমাজে কন্যাশিশুরা সুরক্ষিত এবং পূজিত হয়, সেই সমাজেই প্রকৃত সমৃদ্ধি আসে, এই ধ্রুব সত্যটিই কুমারী পূজার মূল বার্তা। তাই শারদীয়া দুর্গোৎসবে কুমারী পূজা আমাদের হৃদয়ে নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মানবতার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে।

দেবতাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেবী কুমারীরূপ ধারণ করে কোলাসুরকে বধ করেন, আর সেই ঘটনাকেই ভিত্তি করে পৃথিবীতে কুমারী পূজার সূচনা ঘটে। সনাতন ধর্মে নারীর মর্যাদা সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শাস্ত্রকাররাও নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জাগ্রত রাখতে এই পূজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।